গত ১৬ বছর বাংলাদেশ অতিক্রম করেছে এক অন্ধকার ও স্থবিরতার সময়। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নানা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের গুমের মাধ্যমে মানবাধিকার পদ্ধতিগতভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে, আর বিচারব্যবস্থা ব্যবহৃত হয়েছে ভিন্নমত দমনে। এই সময় সাধারণ মানুষও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয়ে দিন কাটিয়েছে। মানবাধিকার কার্যত ছিল অস্তিত্বহীন. সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।
শেখ হাসিনার পতনের পর তার সহযোগীরা এখন বিচারের মুখোমুখি। কিন্তু বিচারিক প্রক্রিয়া চলার মাঝেই কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে থাকা ব্যক্তিদেরই “মানবাধিকার রক্ষক” পরিচয় দিয়েছে—যা বাংলাদেশের জনপরিসরে এই শব্দটির বিশ্বাসযোগ্যতা ও গুরুত্বকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
নুরুজ্জামান লাবু ছিলেন রাষ্ট্র অনুমোদিত এক সাংবাদিক, যিনি সমালোচকদের ভাষায় স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের সহচর ছিলেন। অপ্রত্যাশিতভাবে, ১৮ এপ্রিল ২০২৫ সালে আইরিশভিত্তিক এনজিও ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডার্স (এফএলডি) তাকে “মানবাধিকার রক্ষক” হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। এমনকি সংস্থাটি তাকে নিয়ে “গভীর উদ্বেগ” প্রকাশ করে একটি বিবৃতিও দেয়। এই ঘোষণায় অনেকেই হতবাক হন, কারণ লাবুর দীর্ঘদিনের রেকর্ডে রয়েছে বাংলাদেশের বিতর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের চর্চাকে প্রকাশ্যে সমর্থন করা। সমালোচকরা মনে করিয়ে দেন যে তিনি বারবার “ক্রসফায়ার” সমর্থন করেছেন, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যাকে ঢাকতে ব্যবহৃত এক শব্দ এবং ২০১৯ সালে সিটিটিসি ইউনিট থেকে কাউন্টারটেরোরিজম রিপোর্টিংয়ের জন্য পুরস্কার পেয়েছেন; যে ইউনিটকে ২০২৫ সালের এক জাতিসংঘ ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন রাজনৈতিক দমন-পীড়নে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করেছিল।


এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট র্যাব ও তাদের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরপরই লাবু একটি কলামে বাহিনীটিকে জননিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য হিসেবে প্রশংসা করেন এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনাকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন। এসব অবস্থান হিউমেন রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও রবার্ট এফ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশনের মতো বড় মানবাধিকার সংস্থার অনুসন্ধান ও বিবৃতির সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
এই ঘোষণার পর সামাজিক প্রতিক্রিয়া তীব্র হলে এফএলডি কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই তাদের ওয়েবসাইট ও ইনস্টাগ্রাম থেকে লাবুকে নিয়ে বিবৃতি নীরবে সরিয়ে ফেলে।
এমনই আরেকটি চলমান বিভ্রান্তিকর হলো শাহরিয়ার কবিরের। ওএইচসিএইচআরের অধীনস্থ জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আরবিট্র্যারি ডিটেনশন ২০২৫ সালের আগস্টে তাদের ১০৩তম অধিবেশনে মতামত দেয় যে কবিরের গ্রেপ্তার ছিল “স্বেচ্ছাচারী ও অবৈধ।” একই রিপোর্টে তাকে “মানবাধিকার আন্দোলনের অগ্রণী কর্মী” এবং “ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কারক” হিসেবেও বর্ণনা করা হয়।
কিন্তু সমালোচকরা তার দীর্ঘদিনের বহু বক্তব্যের কথা তুলে ধরেন, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতির সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধে দাঁড়ায়। ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের সময় শাহরিয়ার কবির তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকে আহ্বান করেছিলেন আন্দোলনকারীদের “জামায়াত-শিবির” ও “সন্ত্রাসী” আখ্যা দিয়ে “দেখামাত্র গুলি করতে” আহ্বান জানান। এই আহ্বান জাতিসংঘের কনভেনশন অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের মৌলিক অধিকারকে সরাসরি অস্বীকার করে।
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের আন্দোলনকারীদের দেখামাত্র গুলি করতে শাহরিয়ার কবিরের আহ্বান
২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামী নেতাদের শাস্তি দেওয়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) বিচারের অন্যতম প্রবল সমর্থক ছিলেন শাহরিয়ার কবির। বহু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও মানবাধিকার সংস্থা এই ঘটনাকে রাজনৈতিক পক্ষপাত, প্রক্রিয়াগত ত্রুটি এবং ন্যায়বিচারের মানদণ্ড উপেক্ষার অভিযোগ এনেছে; কেউ কেউ এটিকে “ক্যাঙ্গারু কোর্ট” বলেও অভিহিত করেছেন। “একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি”-র সভাপতি হিসেবে কবির এই বিচারগুলোকে ঘিরে রাজনৈতিক বয়ান তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। সম্প্রতি শেখ হাসিনার পতনের পর আদালত এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলাকে “ন্যায়বিচারের নামে ভয়াবহ অবিচার” আখ্যা দিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড বাতিল ও পূর্ণ খালাস দেয়। আপিল বিভাগ এটিকে স্পষ্ট ভাষায় “ইনজাস্টিস ইন দ্য নেম অফ জাস্টিস” বলে বর্ণনা করে। এই ঘটনাই আইসিটির নিরপেক্ষতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তোলে এবং বহুদিনের সমালোচনাকে আরও তীব্র করে।
সমালোচকরা মনে করেন, ওএইচসিএইচআরের অবস্থানে এক ধরনের গুরুতর অসামঞ্জস্যতা দেখা গেছে। সংস্থাটিই রিপোর্ট করেছে যে জুলাই অভ্যুত্থানে প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত হয়েছে; অথচ তাদেরই ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আরবিট্র্যারি ডিটেনশন সেই শাহরিয়ার কবিরকে “মানবাধিকার রক্ষক” বলছে, যিনি প্রকাশ্যে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, এটি ওয়ার্কিং গ্রুপের যাচাই-বাছাই পদ্ধতির দুর্বলতা ও জমা দেওয়া তথ্য বিনা যাচাইয়ে গ্রহণ করার প্রবণতাকে সামনে আনে। এসবের ফলে “মানবাধিকার রক্ষক” পরিভাষাটির অর্থ ক্ষুণ্ণ হয়, নিজেদের ম্যান্ডেটের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং যারাই রাষ্ট্রীয় সহিংসতায় জড়িত ছিল তাদের অনিচ্ছাকৃতভাবে বৈধতা দেওয়া হয় বলে মনে করেন তারা।
